দেবী মাতঙ্গী হলেন দশমহাবিদ্যার নবম মহাবিদ্যা। তিনি কিরাতরূপী মহাদেবের সঙ্গে চণ্ডালিনীরূপে মিলিত হয়েছিলেন। শিবের বরে তিনি "উচ্ছিষ্টা চণ্ডালিনী" নাম পরিচিতা। শক্তি পূজান্তে তাঁর নামে পূজা দিলে তবেই পূজার সিদ্ধি ঘটে। দেবী মাতঙ্গির ধ্যানে বলা হয়েছে, তিনি রত্নময় বেদিতে বিনাবাদনরতা অবস্থায় উপবেশন করে আছেন। প্রস্ফুটিত শতদলের উপর তিনি তাঁর একটি চরণ রেখেছেন।তাঁর মস্তকে শোভিত চন্দ্রকলা, তাঁর কণ্ঠে শ্বেতপদ্মের মালা দোদুল্যমান এবং তিনি রক্তবস্ত্র পরিহিতা। তাঁর মাথার চুল একত্র করে বাঁধা। শঙ্খপাত্রে অমৃত পান করে তিনি বিহব্বল হয়ে আছেন। তাঁর কপালে বিচিত্র তিলক সুশোভিত। বৈদিক আচার্যদের মতে, তিনি স্বরস্বতী স্বরূপা, কেননা তাঁর চারটি হস্তে চারটি বেদ প্রতিষ্ঠিত আছেন, এবং তিনি বীণাবাদনের মাধ্যমে বিদ্যা বিতরণ করছেন। খ্যাতিমান গ্রহ রবি সঙ্গত কারণে তাঁর উপাসনা করে থাকেন।
চন্দ্রের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ও তার বর্ণনা :
মঙ্গল গ্রহের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন "বগলামুখী"
বুধ গ্রহের অধিষ্ঠাত্রী দেবী "ত্রিপুরাসুন্দরী"
দশমহাবিদ্যার পঞ্চম মহাবিদ্যা হলেন এই দেবী। মহিষাসুরকে বোধের পূর্বে দূর্গা যে চন্ড মূর্তি ধারণ করেছিলেন, তিনিই হলেন ত্রিপুরাভৈরী বা ত্রিপুরাসুন্দরী। শিবকে স্বামীরূপে পাওয়ার জন্য হিমালয় কোননা উমা কঠোর তপস্যা করেছিলেন। তাই তিনি অপর্ণা বা ত্রিপুরাভৈরবী। তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করে তিনি হলেন কালভৈরবের ভার্যা, এই অর্থেও তিনি ভৈরবী। তিনি সূর্যকল্প রক্তবর্না এবং রক্তবস্ত্র পরিহিতা। তিনি অসুরদলনী, তাঁর কণ্ঠে বিভিন্ন বর্ণের মুণ্ডমালা। তাঁর চারটি হস্তে যথাক্রমে জপমালা, শাস্ত্রগ্রন্থ, বরমুদ্রা ও অভয়মুদ্রা উপস্থাপিত। তাঁর তিনটি নেত্রে বেদ রক্ষিত। এই দেবীর মুখশ্রী পদ্ম সাদৃশ্য, তিনি দুঃখসংহন্ত্রী, যমদুঃখনাশিনী। মনন শক্তিকারক গ্রহ বুধ ত্রিপুরাসুন্দরীর উপাসনা করেন।
বৃহস্পতি গ্রহের অধিষ্ঠাত্রী দেবী "তারা":
দশমহাবিদ্যার দ্বিতীয় মহাবিদ্যা হলেন জগন্মাতা। তিনি তারা, তারিণী, ভবানী, তিনিই মা দূর্গা। তিনি তারা অর্থাৎ নক্ষত্র বা জীবজগতের চোখের মনি। তিনি তারিণী, অর্থাৎ ভক্তদের চণ্ডরূপ বিপদ থেকে রক্ষা করেন। তিনি ভবানী, অর্থাৎ জগৎ পালন করেন। তিনি দূর্গা, কারণ তিনি মহামায়া ও ভাগবতী -সৃষ্টিকর্ত্রী পরমেশ্বর স্বরূপা। তিনি নীলবর্ণা, খর্বাকৃতি, লম্বোদরী, মুণ্ডমালা বিভূষিতা। বাঘছালে তাঁর কটিদেশ আবৃত। তিনি চতুর্ভূজা- তাঁর ডানহাতে খড়গ এবং কাটারি, বামহাতে খরপর ও পদ্ম। তিনি ত্রিনয়নের দ্বারা অভয় প্রদান করেন। বিশ্বব্যাপী জলের মধ্যে তিনি শ্বেতপদ্মে বিরাজ করেন এবং ভক্তদের পারের সন্ধান দেন। তিনি জ্বলন্ত চিতার মধ্যেও অবস্থান করেন, তাই তিনি অন্তিমের ভাবনা জাগিয়ে তোলেন, ভক্তদের আধ্যাত্মবাদের সন্ধান দেন। পরম প্রজ্ঞাবান বৃহস্পতি গ্রহ তাই জগন্মাতা তারার উপাসনা করেন।
শুক্র গ্রহের অধিষ্ঠাত্রী দেবী "ভুবনেশ্বরী ":
দশমহাবিদ্যার চতুর্থ মহাবিদ্যা হলেন ভুবনেশ্বরী দেবী। সৃষ্টিকর্তা ব্রম্ভা যখন সৃষ্টির বাসনায় তপস্যামগ্ন ছিলেন, তখন মহামায়া ভূবনেশ্বরী রূপে তাঁকে দর্শন দেন। জগন্মাতা দুর্গাকে তাই ভুবনেশ্বরী বলা হয়। তিনি বিশ্ব পালন করেন। যতদিন পর্যন্ত বসুন্ধরা শস্যশ্যামলা হয়নি, ততদিন পর্যন্ত মাতা ভুবনেশ্বরী তাঁর করস্থিত ফলমূল শাকসবজি দিয়ে জীবের প্রাণ রক্ষা করেন, এজন্য তাঁর নাম হয় শতাক্ষী এবং শাকম্ভরী। তিনি সূর্যের মতো প্রভাময়ী, তাঁর মস্তকে চন্দ্রকিরীট। তিনি হাস্যময়ী। এই চতুর্ভূজা দেবীর বামহস্ত বরমুদ্রা ও পাশ এবং ডানহস্তে অংকুশ ও অভয়মুদ্রা। এই ত্রিনয়না দেবীর দক্ষিণ পদটি রত্ন ঘটের উপর অবস্থিত। তিনি যেমন পৃথিবীকে জলময়তা থেকে উদ্ধার করেছেন। এই দেবীর সন্তানবৎসলা ও ভক্তদের পরমাশ্রয় এবং তিনি সৃষ্টিরক্ষাকর্তী। একারণে বীর্যবান শুক্র গ্রহ নিয়ত তাঁর ভজনা করেন।
শনি গ্রহের অধিষ্ঠাত্রী দেবী "দক্ষিণাকালী"
দশমহাবিদ্যার প্রথম মহাবিদ্যা হলেন দক্ষিণাকালী বা কালীমাতা। স্বরূপগত ভাবে কালী এক, কিন্তু ভক্ত হৃদয়ে তিনি বিভিন্নরূপে বিরাজিতা, যেমন - দক্ষিণাকালী, সিদ্ধকালী, গুহ্যকালী, শ্রীকালী, ভদ্রকালী, চামুণ্ডাকালী, স্মশানকালী ও মহাকালী। দক্ষিণাকালী বা কালীমাতা হলেন করালবদনা, মুক্তকেশী, ঘোর আকৃতি বিশিষ্ট ও চতুর্ভূজা। তিনি মুণ্ডমালাবিভূষিতা। তাঁর বামহস্তে রক্ত ক্ষরিত নরমুণ্ড ও খড়গ এবং ডানহস্তে স্থিত হয়ে আছে অভয়মুদ্রা ও বরমুদ্রা। শ্যামবর্ণা এই দেবী দিগম্বরী। সাধকের নিকট তিনি চিন্ময়ী, ব্রম্ভস্বরূপা, স্বগুনা এবং নির্গুণা। তিনি তাই অখণ্ড মন্ডলকার। তিনি আবরণহীন, ফলে তিনি মায়াতীত। তিনি সংসার বন্ধনকারী, আবার তিনি মৃত্যুর প্রতীক। একাধারে তিনি রোগ, শোক ও মহামারী বিষকুম্ভ থেকে বিতরণ করেন, আবার আরাধনাকারীকে তিনি মুক্তিময় অমৃত দান করেন, ভক্তের নিকট তাই তিনি করুণাময়ী মহামায়া। একারণে ধর্মরাজ শনি নিয়ত তাঁর আরাধনা করেন।
রাহুর অধিষ্ঠাত্রী দেবী "ছিন্নমস্তা":
দশমহাবিদ্যার ষষ্ঠ মহাবিদ্যা হলেন এই ছিন্নমস্তা দেবী। দেবী পার্বতী একদিন মন্দাকিনী ধারায় স্নান করতে গিয়েছিলেন, তাঁর সঙ্গে ছিলেন তাঁর দুই সখি- ডাকিনী ও বর্ণিনী। তাঁদের হঠাৎ ক্ষুদার উদ্রেক হলে দেবীর কাছে আহার্য প্রার্থনা করেন। কিন্তু বারবার এভাবে একই প্রার্থনা করে দেবী ঈষৎ কুপিতা হয়ে তাঁর বাম নখর দিয়ে নিজের মস্তক ছিন্ন করেন এবং নিজের মস্তকটি ডানহস্তে ধারণ করেন। তৎক্ষণাৎ ছিন্ন গলদেশ থেকে তিনটি রক্তধারা নির্গত হলো। এর একটি ধারা গেল বাম দিকের ডাকিনীর মুখে আর একটি ধারা গেল ডানদিকের বর্ণিনীর মুখে এবং তৃতীয় ধারাটি গেল দেবীর ছিন্ন মুন্ডের মুখে। এই দেবীর মুখ বিকৃত, তাঁর উগ্র জিভটি লেলিহান অবস্থায় আছে। তাই তিনি ভয়ঙ্করী। দেবীর গাত্রবর্ণ কালো হলেও তিনি কোটি সূর্যের মতো প্রভাবিশিষ্ট। এই দিগম্বরীর গলদেশে নাগ উপবীত ও সঞ্চরণশীল মালা। জগতে মস্তক হলো অহংকারের মূল উৎস, তাই দেবী ছিন্নমস্তা। তাঁকে আরাধনা করলে শিবত্ব লাভ হয়। নির্মম ও নিরহংকারী সাধনার দ্বারা তাঁকে প্রাপ্ত হওয়া যায়। ছিন্ন মস্তক ও ত্যাগের অধিকারী গ্রহ রাহু তাই এই দেবীর নিয়ত উপাসনা করে থাকেন।
কেতু গ্রহের অধিষ্ঠাত্রী দেবী "ধূমাবতী":
দশমহাবিদ্যার সপ্তম মহাবিদ্যা হলেন এই দেবী ধূমাবতী। দেবী সতী স্বামী নিন্দায় বিহুবলচিত্ত হয়ে দেহত্যাগ করেন। তখন তাঁর দেহ থেকে বিপুল ধুমরাশি নির্গত হয়েছিল, তা থেকে ধূমাবতী দেবীর উত্থান ঘটে। এই দেবী হলেন বিবর্না, চঞ্চলা, কৃষ্ণা ও দীর্ঘাঙ্গী। তিনি মলিন বস্ত্র পরিহিতা, তাঁর কেশরাশিও বিবর্ণ এবং বিরলদন্তী। তিনি রুক্ষা ও বিধবা। তাঁর চোখগুলি রুক্ষ ও কালো। তিনি কম্পিত হস্তে সুর্প ধরে আছেন। তাঁর ওপর হস্তে রয়েছে বরমুদ্রা। তিনি বিশাল বদনা, কুটিল নয়না, কলহপ্রিয়, স্বভাব কুটিলা ও সর্বদা ক্ষুদা তৃষ্ণায় কাতর এবং তাঁর হস্ত দুইটি সদা কম্পমান। তিনি হয়তো মোক্ষ দান করেন না, কিন্তু এই দেবী কিন্তু শত্রুবিনাশিনী। কেতু হৃদয়হীন গ্রহ হলেও কৈবল্যের কারণ এবং তাঁর অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন এই দেবী ধূমাবতী। দেবী ধূমাবতী শত্রুনাশ করেন এবং রাহুগ্রহ স্থবির চিত্তে পাপনাশ করেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন