কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ
(তান্ত্রিক কালীসাধক)
তান্ত্রিক ও কাপালিক কালীসাধকদের কাছে কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। বাংলার সাধকগণ যখন তন্ত্রের মূল ধারা থেকে বিচ্যুত হতে বসেছিলেন তখন আদ্যাশক্তি মহামায়া তাঁকে তন্রশাস্ত্রের পুনরুদ্ধার এবং তাঁর মাতৃরূপিণী বিগ্রহের পূজা করার নিদেশ জ্ঞাপন করেন। তখন আগমবাগীশ অনুনয়ের সুরে বলেন,- "মা -তোমার যে রূপের পূজা আমি করবো সেই রূপ আমায় দেখিয়ে দাও" , মা- তখন বলেছিলেন মানবদেহের মধ্যেই আমার রূপ আমি দেখিয়ে দেব। এই রাত শেষে পরদিন প্রাতঃকালে যে নারীকে যে রূপে যে ভঙ্গিতে দেখবে, সেইরূপ মূর্তি গড়ে আমার পূজার প্রচলন করবে। পরদিন আগমবাগীশ গঙ্গার দিকে কিছুটা অগ্রসর হওয়ার পর এক শ্যামলা গোপকুমারীকে দেখতে পান। ঐ নারীর দক্ষিণ পদ এক বিশেষ ভঙ্গিতে বারান্দার উপরে এবং বামপদ মাটিতে দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি ডান হস্তে গোবর নিয়ে মাটির দেওয়ালে প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। তাঁর এই ধরণ বরাভয় মুদ্রার ন্যায় মনে হচ্ছিল। পরনে ছিল স্বল্প পরিসরের কাপড়। আগমবাগীশকে দেখে তিনি লজ্জায় জিভ কেটেছিলেন। এইরূপ ভঙ্গি দেখে কৃষ্ণানন্দের মায়ের আদেশের কথা মনে পড়ে গেলো। এরপরই তিনি ঐ নারীর রূপকে দেখে মায়ের মূর্তি রচনা করে পূজা প্রচলন করেন। তিনি "তন্ত্রসার" ও "শ্রী তত্ত্ববোধিনী" নাম দুইখানি গ্রন্থ রচনা করেন। সেইসময়ের পণ্ডিতগণের নিকট এই গ্রন্থ সমাদৃত লাভ করে এবং এখনো পর্যন্ত এই গ্রন্থ তান্ত্রিক তথা সকল সাধকের নিকট পরম আদরণীয়।
শঙ্করাচার্য:
শঙ্করাচার্য ৬৮৬ ক্রীষ্টাব্দে ১২- ই বৈশাখ শুক্লাপঞ্চমী তিথিতে ভারতের দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্তে কেরল দেশের মালাবার প্রদেশের কালাডি গ্রামের নম্বুরী ব্রাম্ভন বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শিবগুরু এবং মাতার নাম বিশিষ্টা দেবী। ভগবান শঙ্করের বরে শঙ্করের জন্ম বলে তাঁর নাম রাখা হয়েছিল শঙ্কর।
শঙ্করের বয়স তিনবছর পূর্ণ হওয়ার আগে তাঁর পিতা মৃত্যুবরণ করেন। শিশুকাল থেকেই শঙ্কর ছিলেন অসামান্য প্রতিভার অধিকারী। তিনি ছিলেন শ্রুতিধর অর্থাৎ সব কিছু শুনেই আত্মস্থ করতে পারতেন। তিনি ৫ বছর বয়সে বেদ অধ্যয়নের জন্য উপনয়ন দিয়ে গুরুগৃহে গমন করেন।
দুই বছরের মধ্যে অর্থাৎ সাত বছর বয়সেই বেদবেদাঙ্গ পাঠ সমাপ্ত করে ফেলেন। শঙ্করের মাতা বিশিষ্টা দেবী গৃহ থেকে বেশ দূরে আলোয়াই নদীতে স্নান করতে যেতেন। একদিন স্নান করে গৃহে ফেরার পথে বিশিষ্টা দেবী ক্লান্তিবশত মুর্ছিতা হয়ে পড়লেন। শঙ্কর মাতাকে সেবাশুশ্রূষা দ্বারা সুস্থ করে তুললেন এবং মাতাকে যাতে দূরে স্নান করতে না হয়, সি জন্য আলোয়াই নদীকে তাঁদের গৃহের নিকট হতে প্রবাহিত হওয়ার অনুরোধ জানালেন। তারপর থেকে আলোয়াই নদী তাঁদের গৃহের নিকট হতে প্রবাহিত হতে থাকলো। সত্যিই এরকম মাতৃভক্তি জগতে বিরল।
একদল জ্যোতিষী শঙ্করের কোষ্ঠী বিচার করে দেখলেন যে, শঙ্করের আয়ু আট বছর। তবে তপস্যা প্রভাবে আরও আট বছর বর্ধিত হতে পারে। একথা শুনে শঙ্করের মনে সন্ন্যাস নেওয়ার ইচ্ছা জাগলো। কিন্তু মাতা তাঁকে সন্ন্যাস গ্রহণের অনুমতি দিলেন না। একদিন শঙ্কর আলোয়াই নদীতে স্নান করার সময় একটি কুমির তাঁকে ধরে নিয়ে গভীর জলে নিয়ে যেতে লাগলো। মাতা তাঁকে রক্ষা করতে ছুটে আসলে "মা সন্ন্যাসের অনুমতি দাও" বলে চিৎকার শুরু করলেন। মাতা তখন তাঁকে অনুমতি দেওয়ার সাথে সাথে কুমির শঙ্করকে ছেড়ে দিল। এভাবে অলৌকিক উপায়ে মাতার নিকট সন্ন্যাসের অনুমতি নিয়ে গৃহত্যাগ করলেন। তবে যাওয়ার আগে তিনটি প্রতিজ্ঞা করে গেলেন। প্রতিজ্ঞা তিনটি এইরকম - তিনি মায়ের মৃত্যুকালে তিনি দর্শন দেবেন, মায়ের মৃত্যকালে ভগবান দর্শন করবেন রবং তিনি নিজ মায়ের সৎকার করবেন।
শঙ্কর গৃহত্যাগ করে নর্মদা তীরে এসে গোবিন্দপাদ নাম এক সিদ্ধপুরুষের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। শঙ্করাচার্য গুরুর নির্দেশে বেদান্ত প্রচারের জন্য কাশীধাম গমন করেন। পরে সেখান থেকে বদরিকা আশ্রমে এসে গুরুর নির্দেশ মতো উপনিষদ, ব্রম্ভপুত্র ও গীতার ভাষ্য রচনা করেন। শঙ্করের বয়স ষোলো বছর পূর্ণ হলে মহর্ষি ব্যাসদেব এসে তাঁর আয়ু আরো ষোলো বছর বর্ধিত করে যান।
শঙ্কর বেদান্ত প্রচারের নিমিত্ত সশিষ্য ভারতের বিভিন্ন স্থান ভ্রমণ করেন। এবং বিভিন্ন স্থানের পন্ডিতদের তর্কযুদ্ধে পরাজিত করে বেদমন্ত দর্শনের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেন। তিনি আকাশপথে উড়ে এসে মীমাংসাকার কুমারিল ভট্টের শিষ্য মন্ডনকে তর্কশাস্ত্রে পরাজিত করেন। একদিন শঙ্করের পান্ডিত্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে উগ্রভৈরব, ক্রবাচ প্রভৃতি কাপালিকরা তাঁকে হত্যা করতে এসে অলৌকিক উপায়ে নিজেরাই নিহত হন।
শঙ্করাচার্য একদিন সুক্ষদেহে অম্রুক নামক রাজার মধ্যে প্রবেশ করে স্ত্রী সন্মন্ধে অনেক বিষয় শিক্ষা অর্জন করে একটি স্ত্রী চরিত্র সম্মন্ধীয় গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি মাতা বিশিষ্টা দেবীর মৃত্যুর পূর্বকালে শুন্যপথে মায়ের নিকট উপস্থিত হয়ে পূর্বের তিনটি প্রতিজ্ঞা পালন করেন। শঙ্করাচার্য কাশী, কাঞ্চি, কর্ণাট, কামরূপ প্রভৃতি স্থানে ভ্রমন করে বেদান্ত প্রচার করেছিলেন। জীবনের শেষদিকে তিনি কাশ্মীর গমন করেন। সেখানে প্রচারকার্য শেষ হলে বদ্রিকাশ্রমে চলে যান এবং শিষ্যদের তাঁর প্রতিষ্ঠিত মঠে গিয়ে প্রচারকার্য করার নির্দেশ দেন। কিন্তু শিষ্যরা গুরু সঙ্গ ত্যাগ করতে সম্মত না হওয়ায় তাঁদের সঙ্গে কিছুদিন হিমালয়ের কেদারধামে বাস করেন। তারপর সেখানে তাঁর বত্রিশ বছর বয়স পূর্ণ হলে
মহাসমাধি যোগে তিনি দেখত্যাগ করেন।
ভারতবর্ষের সাধক
রামানুজ :
সাধক রামানুজ কেশব ত্রিপাঠীর ঔরসে ভূমিদেবীর গর্ভে মাদ্রাজের পেরুম্বুর নামক স্থানে ১০১৭ মতান্তরে ১০৩৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কাঞ্চিপুরে শিক্ষালাভ করেন এবং কাবেরী নদীর দুই শাখার মধ্যবর্তি শ্রীরঙ্গ দ্বীপে উপাসনা করেন। শ্রীরঙ্গ ধামে বসে তিনি বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি ভারতবর্ষের নানা স্থানের নানা পন্ডিতদের তর্কবিচারে পরাজিত করেন। ব্যাঙ্কটগিরি নামক স্থানে তিনি বিষ্ণুমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। কর্ণাটে বেতালদেব নামক এক রাজা ছিলেন। রাজা বেতালদেব ছিলেন জৈন ধর্মের উপাসক। রামানুজ রাজা বেতালদের কন্যাকে দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্ত করায় রাজা রামানুজের নিকট বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। তারপর তিনি কাঞ্চিপুর, মহারাষ্ট্র, দ্বারকা প্রভৃতি স্থানে বৈষ্ণব মত প্রচার করেন। পরে তিনি বারাণসী, প্রয়াগ, হরিদ্বার প্রভৃতি তীর্থ ভ্রমণ করেন। রামানিজ ১০৫৭ মতান্তরে ১০৭৭ সালে ৪০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
ভারতবর্ষের সাধক
মাধবাচার্য :
মাধ্বী সম্প্রদায়ের প্রবর্তক মাধবাচার্য দক্ষিণাপথে ১১২১ শকাব্দ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মোধীজি ভট্ট। কথিত আছে মহর্ষি ব্যাসদেব সাধক মাধবাচার্যকে তিনটি শালগ্রাম শিলা উপহার দেন এবং তিনটি সুব্রম্ভন। উদিপী ও মধ্যতল নামক স্থানের তিনটি মঠে ঐ শালগ্রামশীলা প্রতিষ্ঠিত করেন। এর মধ্যে উদিপী নগর মাধ্বাচারীদের প্রধান তীর্থক্ষেত্র। এছাড়াও তিনি আটটি মন্দির নির্মাণ করেন। সেই আটটি মন্দিরে তিনি রাম সীতা , লক্ষ্মণ ও সীতা, দ্বিভুজ কালিয়ামর্দন, চতুর্ভূজ, সুবিমল, শুকর, নৃসিংহ এবং বসমত্ম বিটল এই আট প্রকার মূর্তি স্থাপন করেন। মাধবাচার্য উদিপী মঠে বসে দশোপনিষদ এবং ব্রম্ভসূত্র ভাষ্য, অনুবাকানুনয়বিবর্ণ, অনুবেত্তারস প্রকরণ, ভারত তাৎপর্য নির্ণয়, গীতা তাৎপর্য, কৃষ্ণমৃত মহার্ণব তন্ত্রসার প্রভৃতি ৩৬ খানা গ্রন্থ রচনা করেন।
শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু :
শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে (১৪০৭ শকাব্দ ) ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমায় নবদ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম জগন্নাথ মিশ্র এবং মাতা শচীদেবী। জগন্নাথ মিশ্র পূর্বে শ্রীহট্টে বাস করতেন। পরে তিনি গঙ্গাবাসের উদ্দেশ্যে নবদ্বীপে বাস করা শুরু করলেন। অল্প বয়সেই চৈতন্যদেব পিতাকে হারান। তাঁর জেষ্ঠভ্রাতা বিশ্বরূপ পিতার মৃত্যুর পূবেই সন্ন্যাস গ্রহণ করে গৃহত্যাগ করেন। শ্রী চৈতন্য বললে নিমাই নাম পরিচিত ছিলেন। নিমাই গঙ্গাদাস পন্ডিতের পাঠশালায় কৃষ্ণানন্দ, কমলাকান্ত, মুরারি গুপ্ত প্রভৃতি সহপাঠীদের সাথে শিক্ষা অর্জন করেন। তিনি নবদ্বীপের বিশিষ্ট ব্রাম্ভন বল্লভাচার্যের মেয়ে লক্ষ্মীদেবীকে বিবাহ করেন। তিনি বুদ্ধি ও স্মৃতিশক্তির জোরে ক্রমান্বয়ে নবদ্বীপের শ্রেষ্ঠ পন্ডিত হয়ে ওঠেন এবং নবদ্বীপে অধ্যাপনা শুরু করেন। নিমাই পিত জগন্নাথ মিশ্রের পিতৃভূমি পূর্বঙ্গের শ্ৰীহট্ট তে (বর্তমান সিলেট) ভ্রমণকালে তাঁর স্ত্রী সর্পদংশনে মৃত্যুবরণ করেন। তারপর তাঁকে রাজপণ্ডিত সনাতনের কন্যা বিষ্ণুপ্রিয়ার সাথে বিবাহ দেওয়া হয়। গয়ায় পিতৃদেবের পিন্ড দিতে গিয়ে মাধবেন্দ্র পুরীর শিষ্য ঈস্বরপুরীর নিকট দীক্ষা গ্রহণ ফায়ার আসেন। দীক্ষা গ্রহণের পর থেকে নিমায়ের অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেলো। ধীরে ধীরে নিমাই টোলের অধ্যাপক থেকে কৃষ্ণপ্রেমিক হতে শুরু করলেন। ২৪ বছর বয়সে নিমাই মাতা ও স্ত্রীকে ত্যাগ করে কাঠওয়াতে এসে সন্ন্যাসী কেশব ভারতীয় নিকট সন্ন্যাস গ্রহণ করেন।
তখন তাঁর নাম হয় শ্ৰীকৃষ্ণ চৈতন্য। সন্ন্যাস নেওয়ার পর চৈতন্যদেব। একবার নবদ্বীপের কাছে শান্তিপুরে অদৈত এর বাড়িতে এসেছিলেন। যেখানে মাতা শচীদেবীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু সন্ন্যাসীদের স্ত্রী-সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ বলে বিষ্ণুপ্রিয়া চৈতন্যদেবকে দর্শন করতে পারেন নি। শান্তিপুর থেকে চৈতন্যদেব পুরীতে গমন করেন। পরেও আরেকবার তিনি নবদ্বীপে এসে মায়ের সাথে দেখা করেছিলেন এবং তখন বিষ্ণুপ্রিয়াকে পাদুকা দান করেছিলেন। নিত্যানন্দ, অদৈত, গদাধর, শ্ৰীনিবাস, রামানন্দ, হরিদাস প্রভৃতি বৈষ্ণবগণ ছিল তাঁর প্রধান পার্ষদ। এদের মধ্যে অদৈত ও নিত্যানন্দকে চৈতন্যের দুই অঙ্গ স্বরূপ কল্পনা করা হয়। নিত্যানন্দ চৈতন্যের খুবই প্রিয়ভাজন ছিলেন। নিত্যানন্দ একবার জগাই ও মাধাই নামক নদিয়ার দুই পাপিষ্ঠ ব্রাম্ভন কুমারকে উদ্ধার করতে চাইলেন। সে লক্ষে তিনি অনেক ভক্তদের সাথে নিয়ে নামকীর্তন করতে জগাই মাধাইয়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। জগাই মাধাই মদ পান করে ঘুমোচ্ছিলেন। নামকীর্তন শুনে তাদের ঘুম ভাঙ্গায় তারা খুব বিরক্ত হলেন। নিত্যানন্দ বার বার তাদের হরিনাম করার অনুরোধ করলেন। মাধাই তখন ক্রোধান্বিত হয়ে নিকটস্থ একটি ভাঙা কলসির টুকরোর দ্বারা নিত্যনন্দকে আঘাত করলেন। ফলে নিত্যানন্দের কপাল থেকে রক্ত ঝরতে লাগলো। চৈতন্যদেব ঐস্থানে ছুটে আসলেন। তিনি জগাই মাধাইকে শাস্তি দেওয়ার জন্য সুদর্শন চক্রকে স্মরণ করলেন। কিন্তু নিত্যানন্দ তাঁকে নিরস্ত করলেন। শত্রূ কর্তৃক আঘাত পেয়েও শত্রুকে ক্ষমা করার মতো উদারতা আর কি হতে পারে ? নিত্যানন্দের উদারতা ও মহত্ব দেখে জগাই মাধাইয়ের বোধোদয় হয়। অবশেষে গৌড় নিতাইয়ের পরশে মাধাই শুদ্ধ বৈষ্ণব ভক্ততে পরিণত হয়। বৈষ্ণবদের মধ্যে শ্রী চৈতন্য রাধা ও কৃষ্ণের মিলিত রূপ। নিত্যানন্দ, বলরাম, অদৈত সদাশিব, শচীদেবী, যশোদা এবং জগন্নাথ মিশ্র নন্দ চৈতন্যদেবের অনুসারী ছয়জন গোস্বামী ছিলেন যাঁরা অনেক বৈষ্ণবশাস্ত্র রচনা করেন। সে ছয়জন গোস্বামী হলেন - রূপ, সনাতন, জীব, রঘুনাথ ভট্ট, রাঘনাথ দাস এবং গোপাল ভট্ট। এছাড়াও চৈতন্যদেবের অনুসারী আটজন কবিরাজ ও চৌষট্টি জন মহন্ত ছিলেন। সন্ন্যাস নেওয়ার পর চৈতন্যদেব ছয়বছর মথুরায় অবস্থান করেন। তিনি পুরুষোত্তম ক্ষেত্র সহ নানা স্থান পর্যটন করে বৈষ্ণব মত প্রচার করেন এবং শিষ্য সংগ্রহ করেন। তারপর তিনি রূপ ও সনাতনকে মথুরায় এবং অদৈত ও নিত্যানন্দকে বাংলার প্রচার কার্যে নিযুক্ত করে নীলাচলে গমন করেন।
নীলাচলে মহাপ্রভু শেষ ১৮ বছর জগন্নাথের সেবায় রত ছিলেন। শেষদিকে তিনি ভাবে উন্মক্ত হয়ে থাকতেন। কথিত আছে যে, তিনি সমুদ্রকে যমুনা ভেবে এবং শ্ৰীকৃষ্ণ যে যমুনার জলে গোপিকাদের সাথে ক্রীড়া করছেন এমন উপলব্ধি করে ঐ সমুদ্রের জলে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। এটাই প্রেম ভক্তির চূড়ান্ত স্তর। ভাবের এই চূড়ামত্ম সত্তরে উপনীত হলে সবত্রই প্রেমাস্পদের দর্শন মেলে। মহাপ্রভু ১৫৩৪ ক্রিষ্টাব্দে ইহলীলা সংবরণ করেন। মহাপ্রভু শিষ্যদের উপদেশ দিয়েছেন :-
"তৃণাদপি সুনীচেন তরুবের সহিষ্ণুনা।
অমানিনা মানদেন কীর্তনিয়া সদাহরি।"
অর্থাৎ তৃণ হতেও নীচ (নম্র) হবে, তরু হতেও সহিষ্ণু হবে, অহংকার শুন্য হয়ে সকলকে সম্মান করবে এবং সবসময় হরিনাম করবে। চৈতন্যদেব ভক্তদের শিক্ষার জন্য আটটি শ্লোক রচনা করেন যা শিক্ষাষ্টক নাম পরিচিত।
তুলসীদাস:
সাধক তুলসীদাস ছিলেন রামভক্ত। তিনি গৃহস্থ আশ্রমে থাকাকালে স্ত্রীকে খুব ভালোবাসতেন। একদিন তিনি গৃহের বাইরে থাকাকালীন তাঁর স্ত্রী পিতৃগৃহে গমন করেন। তিনি গৃহে ফিরে স্ত্রীকে দেখতে না পেয়ে প্রণয়বশতঃ শশুরবাড়ি গিয়ে স্ত্রীর নিকট উপস্থিত হন। স্ত্রী তাঁর এই নির্লজ্জ স্বভাবের জন্য তাঁকে তিরস্কার করেন। স্ত্রীর ভৎসনা শুনে তাঁর মনে বৈরাগ্য আসে এবং নিজ গৃহ ত্যাগ করে শ্রী রামচন্দ্রের উপাসনা শুরু করেন। কথিত আছে তিনি চিত্রকূটে হনুমানজির দর্শন পান। তাঁর হিন্দি ভাষায় অনুদিত রামায়ণের নাম রামচরিতমানস। এই রামচরিতমানস গ্রন্থই তাঁর অমর কীর্তি।
বামাক্ষেপা:
সাধক বামাক্ষেপা ১৮৪৩ সালে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমে অবস্থিত তারাপীঠের নিকটস্থ মালুটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কৈলাসপতি নামক এক তান্ত্রিক সন্ন্যাসীর স্নেহভাজন ছিলেন। কৈলাসপতির উৎসাহেই তিনি তন্ত্রসাধনা শুরু করেন। এবং তারাপীঠ হয়ে ওঠে তাঁর অধ্যাত্ম সাধনাক্ষেত্র। একদিন তারাপীঠ মন্দিরে মা তারাকে নৈবেদ্য প্রদানের পূর্বেই তিনি তা খেয়ে ফেলেছিলেন। ফলে সেখানকার পুরোহিতরা তাঁর প্রতি ক্ষিপ্ত হলেন। তখন মন্দিরের পরিচালনাকারী নাটোরের মহারানীকে মা তারা তাঁকে আদেশ করেন যে, আগে বামাচরণকে ভোজন করিয়ে পরে তাঁকে ভোজন করাতে হবে। এরপর থেকে মায়ের আদেশানুসারে বামাচরণকে ভোজন করানোর পর মা তারাকে ভোগ নিবেদন করা হতো। বামাক্ষেপা তারাদেবীকে মাতৃরূপে উপাসনা করেছিলেন। তারাপীঠে ভক্তরা সাধক বামাক্ষেপার নানাবিধ অলৌকিক কীর্তি প্রত্যক্ষ করতেন। তাঁর কৃপায় দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত অনেক ভক্তের রোগমুক্তি ঘটেছিলো। ১৯২২ ক্রীষ্টাব্দে শক্তিসাধক বামাক্ষেপা দেহত্যাগ করেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন